চারপাশে জলরাশি। তার মাঝে ছোট্ট এক টুকরো দ্বীপ। এ দ্বীপকে কেন্দ্র করেই কেনিয়া ও উগান্ডার মধ্যে যত দ্বন্দ্ব। কেনিয়া বলে এটা তাদের অঞ্চল, অন্যদিকে উগান্ডা বলে তাদের এলাকা। মিগিঙ্গো নামের ছোট্ট এ দ্বীপের অবস্থান ভিক্টোরিয়া হ্রদের মাঝখানে। ভিক্টোরিয়া হ্রদ আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হ্রদ।
মিগিঙ্গো দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা নৌকায় পাড়ি দিতে হয়। ওই এলাকাজুড়ে প্রচুর মাছের সন্ধান মেলে। তাই তো জেলেদের আনাগোনা বেশি। ওই দ্বীপে বাস করে ৫শ’রও বেশি মানুষ। যেন পা ফেলার জায়গাটুকুও নেই। তার মধ্যেই হরদম চলছে অবৈধ সব কর্মকাণ্ড। মাদক পাচার, যৌনকর্ম, সন্ত্রাসীদের বৈঠকসহ সব অপকর্মই হয় মিগিঙ্গো দ্বীপে।
২ হাজার বর্গমিটারের এ দ্বীপে আছে পাখির ঘরের মতো ছোট ছোট কক্ষ। যেখানে রয়েছে দু’জনের শোয়ার ব্যবস্থা। এ ছোট ছোট ঘরেই যৌনকর্মীরা অপেক্ষায় থাকেন। তাদের আয়ের উৎস মূলত জেলেরা। লেক ভিক্টোরিয়ায় চলাচল করা সব মাছ ধরা নৌকায় থাকা জেলেরা সামান্য অবসরের জন্য দ্বীপে এসে যৌনকর্ম ও নেশায় মেতে ওঠেন।
১৯৯০ এর দশকে মিগিঙ্গো দ্বীপটি জেগে ওঠে। এটি আসলে একটি পাথুরে দ্বীপ। ২০০৪ সাল থেকে দ্বীপটিতে দু’একটি ঘর তৈরি করে জেলেরা অবসর কাটাত। এরপর থেকে ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের আস্তানা হয়ে ওঠে দ্বীপটি। যেহেতু উপকূল থেকে দ্বীপটি বেশ দূরে, তাই সেখানে অপরাধীরা ঘাপটি মেরে দিন কাটাতে পারে।
এ দ্বীপের মালিকানা কার, তা এখনো কেউ জানে না। দ্বীপটি ঘিরে কেনিয়া ও উগান্ডার বিরোধ আছে শুরু থেকেই। কেনিয়ার মূল ভূ-খণ্ড থেকে মিগিঙ্গোতে নৌকায় যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। অন্যদিকে এ দ্বীপ থেকে উগান্ডায় যেতে সময় লাগে ১৮ ঘণ্টা। এ কারণেই কেনিয়াবাসী নিজেদের বলে দাবি করে।
ক্ষেত্রফলের দিক দিয়ে ভিক্টোরিয়া লেক পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশুদ্ধ পানির আধার। তাই মিঠাপানির মাছের কদর আছে ইউরোপজুড়ে। এখান থেকেই সবচেয়ে বেশি মিঠাপানির মাছ রফতানি হয়। মিগিঙ্গো দ্বীপটি একটি ছোট নদী বন্দরে পরিণত হয়েছে। আফ্রিকার সব জেলেই এ দ্বীপে সময় কাটান।
সব কিছুই আছে দ্বীপে। বাজার, দোকান, হোটেল, ইলেক্ট্রনিক্স ও ওষুধের দোকান। ডেলিয়েল ওবাধা (৩৫) একজন কেনিয়ান ইলেক্ট্রিশিয়ান। তিনি এ দ্বীপে গত ২ বছর ধরে সেলুন ও ফোন সার্ভিসিংয়ের দোকান চালাচ্ছেন। এখানে থাকতে তার খুব ভালো লাগে। উপার্জনও অনেক বেশি। তাই তো কেনিয়ার মূল ভূ-খণ্ড ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন।
ঘনবসতিপূর্ণ এ দ্বীপে অস্থায়ী ক্যাসিনো আছে। যেখানে জেলেরা তাদের ভাগ্যের পরীক্ষা দেন। ছোট্ট এ দ্বীপ এতটাই অস্বাস্থ্যকর যে, চারদিকে মাদকদ্রব্যের প্যাকেট থেকে শুরু করে ব্যবহৃত কনডম পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যৌনকর্মীদের শিশুরাও অস্বাস্থ্যকর এ নোংরা পরিবেশে বেড়ে উঠছে।
এত মানুষের জন্য মাত্র ৩টি টয়লেট রয়েছে দ্বীপে। সেই সঙ্গে দ্বীপের চারপাশে শুধু ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ফলে মশার আঁতুরঘর দ্বীপটি। সেখানকার মানুষের বেশিরভাগই এইডস ও ম্যালেরিয়া আক্রান্ত। তার উপরে নেই সঠিক চিকিৎসা। একটি ওষুধের দোকানই তাদের ভরসা। সব মিলিয়ে দ্বীপটি যেন সভ্য সমাজের সীমারেখা ছাড়িয়ে গেছে।
ভাবতে পারেন, প্রশাসন কেন সেখানকার অপকর্ম বন্ধ করছে না? কারণ নামকরা সব সন্ত্রাসীদের রাজত্ব সেখানে। এসব গডফাদারের কাছে প্রশাসনও নির্লিপ্ত। ৫০০ মানুষের জন্য মাত্র ১ জন পুলিশ দ্বীপটি পাহারা দেন। সন্ত্রাসীদের কথায়ই এ দ্বীপ চলে। ছোট থেকে বড় সব সন্ত্রাসীই গা ঢাকা দিতে মিগিঙ্গো দ্বীপে যান। স্ফূর্তি করে তাদের ভালোই সময় কাটে।
দ্য গার্ডিয়ান/আল জাজিরা
0 Comments