বিশেষ প্রতিবেদক:
কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মত একটি প্রস্তাব (রেজুলেশন) গ্রহণ করেছে জাতিসংঘ। স্থানীয় সময় বুধবার জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। এবারই প্রথম এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে কোনো দেশই বিপক্ষে ভোট দেয়নি বা ভোটদানে বিরত থাকার কথা জানায়নি।
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে। এটাকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে। এতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে আশা দেখছে বাংলাদেশ। এ প্রস্তাব পাশ হওয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ এর ফলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটা চাপের মুখে রয়েছে। আর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা তৈরী হওয়ায় খুশি হয়েছে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।এ ছাড়া কক্সবাজারের স্থানীয়রাও প্রত্যাশা করেছেন দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসির পক্ষ থেকে যৌথভাবে উত্থাপন করা এ প্রস্তাবে ১০৭টি দেশ সহ-পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, যা ২০১৭ সালের পর জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে একই বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এর আগেও চারবার একই বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। তবে প্রতিবারই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়েছে এবং একাধিক দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর গৃহীত প্রস্তাবে ১৩২ দেশ পক্ষে ও ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩১ দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। কিন্তু এবারের প্রস্তাবে কেউ বিপক্ষে ভোট দেয়নি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের উত্থাপিত প্রস্তাবে বারবার বিরোধিতাকারী চীন ও রাশিয়াও এবার এই প্রস্তাবের বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি। ফলে ২০১৭ সালের পর এবারই প্রথম রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ইস্যুতে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হলো।
এ খবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য দারুণ সুখবর। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। তবে এখনও নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হয়নি। বাংলাদেশ আশাবাদী যে, ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিষদেও একইভাবে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এখন নিরাপত্তা পরিষদেও একইভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত না হলে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব মিয়ানমার সরকারের কাছে অতীতের মতোই গুরুত্বহীন বিবেচিত হবে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার বাচাঁও আন্দোলনের সাধারন সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই হবে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান। সব মিলিয়ে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মত একটি প্রস্তাব (রেজুলেশন) রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছুটা আশাবাদ তৈরি করছে। এ ইস্যুটি জাতিসংঘে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আছে এবং যে ভাষায় মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে, তা অনেকটা নজিরবিহীন।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এ মুহূর্তে মিয়ানমারের জান্তা যে ধরনের চাপে আছে, সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ সরাসরি তারা হয়তো নেবে না। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামরিক জান্তার ওপর নতুন করে এক ধরনের চাপ সৃষ্টির একটা সুযোগ তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের ভেতরে ও বাইরে অন্য যেসব বাস্তবতা আছে-সবকিছু মিলিয়ে এই সামরিক সরকার যদি একটা দুর্বল অবস্থায় যায়, তাহলে রোহিঙ্গাদের জন্য সেটি ইতিবাচক হবে।
তিনি আরও বলেন,আমরা রোহিঙ্গাদের ব্যাপরে দুধরনের সম্ভাবনা দেখি। একদিকে তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সামরিক জান্তা হয়তো এ চাপের মধ্যেই কোনো একসময় রাজি হতে পারে। কারণ তাদের ওপর ক্ষমতা ছাড়ার চাপ আছে, আবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার চাপও আছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তারা একটা চিন্তা করতেও পারে। কারণ ক্ষমতা ছাড়াটা তাদের জন্য কঠিন হবে।
এদিকে প্রত্যাবাসনকে ঘিরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যূষিত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নানা গুঞ্জন চলছে। রোহিঙ্গারা আগে থেকে স্বদেশে ফিরে যেতে নানা শর্ত জুড়ে দিলেও এখন তারা শর্ত ছাড়াই ফিরে যেতে চায় । শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাশ হওয়ায় প্রত্যাবাসনের আশায় খুশি রোহিঙ্গারা। তারা ক্যাম্পে আনন্দ প্রকাশ করেছে।
প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জহির আহমদ বলেন,রাখাইনই আমাদের মাতৃভূমি।সেখানেই আমরা ফিরে যেতে চাই যত দ্রুত সম্ভব।ক্যাম্পে ভিক্ষা নিয়ে বেচেঁ থাকার কোন মানে হয়না। মরতে হলে সেখানেই মরবো।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ডি ব্লকের রোহিঙ্গা করিম উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠালে আমরা স্ব-উদ্যোগে দেশে ফিরে যাব। আমাদের দাবিগুলো স্বদেশে ফিরে গেলেই মিয়ানমার সরকার মেনে নিতে বাধ্য হবে। কারণ এখন আমরা আগের চেয়ে অনেক প্রতিবাদি হতে শিখেছি।
তালিকায় নাম আসা রোহিঙ্গা নারী জুহুরা খাতুন বলেন, ‘গতকাল রাত থেকে আমাদের ঠিকমতো ঘুম হয়নি।জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানাই দেশে ফিরে যাওয়ার আশা জাগানোর জন্য। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের দাবিগুলো পূরণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাজ করছে।
প্রত্যাবাসনের সুযোগ হওয়ায় খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও। উখিয়া বাজারের মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে। তারা মিয়ানমার ফিরে গিয়ে তাদের জীবন নতুনভাবে তৈরী করতে পারবে। এভাবে তাদের দাবিগুলো স্বদেশে ফিরে আদায় করতে পারবে।যা অন্য দেশে বসে বাস্তবায়ন কোনদিনই সম্ভব হবে না।
এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এবারের গৃহীত প্রস্তাব ইইউ এবং ওআইসির মধ্যে সহযোগিতার ফল। ইইউ এই যৌথ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায়। সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মত এই প্রস্তাব গ্রহণ বিশ্বকে মনে করিয়ে দিতে সাহায্য করবে যে, রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর সংঘটিত এই অপরাধগুলোর সত্য উন্মোচন এবং জবাবদিহি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। যে সামরিক নেতৃত্ব রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল, তাদের নেতৃত্বেই চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এরপর থেকে জান্তা সরকার সশস্ত্র বহিনীকে অভ্যুত্থান বিরোধীদের ওপর হত্যা, নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়েছে। ইইউ এ ধরনের অপরাধের কঠোর নিন্দা জানায়।
এবারের প্রস্তাবে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং জাতীয় কভিড-১৯ ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়েছে, তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের অত্যন্ত জনাকীর্ণ ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার যে বিনিয়োগ করেছে, তারও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানানো হয়।
প্রস্তাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ সব মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। চলমান বিচার ও দায়বদ্ধতা নিরূপণ প্রক্রিয়ার ওপর প্রস্তাবটিতে সজাগ দৃষ্টি ধরে রাখার কথাও বলা হয়েছে। প্রস্তাবে মিয়ানমারে নবনিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতকে স্বাগত জানানো হয়েছে।
প্রস্তাটি গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে, যে জন্য তারা পথ চেয়ে বসে আছে। তিনি আরও বলেন, আশা করা যায় এবারের প্রস্তাবটি নিজ ভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এই রেজুলেশন পাস হওয়ায় রাজনৈতিক দিক থেকে বড় একটা উপকার পাওয়া যাবে। কারণ এবারই প্রথম সর্বসম্মতভাবে রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। এর আগে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো রেজুলেশন পাস করানোর জন্য উঠলেই চীন ও রাশিয়া বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এবার তারা চুপ ছিল। এটাও বাংলাদেশের জন্য বড় সুখবর। এটা বুঝতে সাহয্য করে যে, চীন ও রাশিয়াও চায় রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক। রাশিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, চীনও কিছু ইনিশিয়েটিভ নিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক দিনের চেষ্টার পর আজকের এ সুখবর পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এটা অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে।
তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে রেজুলেশন পাস হয়, সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কোনো বিষয় যুক্ত ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেছে। এ কারণে এবারের রেজুলেশনে প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও এসেছে। এটাও একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনও প্রস্তাব পাস করানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু সেখানে রেজুলেশন পাস হওয়াটা খুব জরুরি। নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচজন স্থায়ী সদস্য একমত না হলে কোনো রেজুলেশন পাস হয় না। বাংলাদেশ আশাবাদী, এবার সেখানেও রেজুলেশন পাস হবে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, প্রথমত, সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকার বুঝতে সক্ষম হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ তারা দীর্ঘায়িত করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সংকটের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি। বরং তারা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকায় রয়েছে। এটা অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের ওপর একটা বড় চাপ সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন, চীন ও রাশিয়া সাধারণ পরিষদের রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দেয়নি। তারা ভোটদানে বিরত থেকেছে। তবে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে রেজুলেশন উঠলে সেখানে যে তারা বিরোধিতা করবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্নেষক হুমায়ুন কবীর বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি বছরই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস হচ্ছে। এবারও একইভাবে প্রস্তাব পাস হয়েছে। এটা প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের অবস্থানকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে। কিন্তু সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজুলেশন দিয়ে কোনো বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এ জন্য নিরাপত্তা পরিষদের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে রেজুলেশন নেওয়ার ক্ষেত্রে পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের ভূমিকা একইরকম নাও থাকতে পারে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হওয়ার আগে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিআইআইএসএসের সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, জাতিসংঘে এই রেজুলেশন গৃহীত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক ঘটনা। আগের বছরগুলোতেও এ ধরনের রেজুলেশন পাস হয়েছে, যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সমালোচনা করা হয়েছে। তবে অন্যবারের তুলনায় একটা পার্থক্য হচ্ছে, এবার সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। যেহেতু এবার সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, যে কারণে চীন, রাশিয়াও এবার ভোটদানে বিরত ছিল- সেটা বলা যাবে না। এখন দেখতে হবে, নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস করানো যায় কিনা। ঝট করেই একটা রেজুলেশন আনা যাবে না। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আরও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করানো না গেলে প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সাধারণ পরিষদের এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে না।
প্রসঙ্গত,মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ, বাড়িঘরে অগ্নিংযোগ ও নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সাগর ও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া শুরু করে। এরপর থেকে নতুন পরাতন মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সরকারি হিসাবে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করে আসছে।
এর একবছর পর কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ধার্য্য করা হয়েছিল। সেদিন বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও এনজিওদের চক্রান্তে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মাঝে প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়। এরপর দ্বিতীয় দফা ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিন ধার্য করে ৩৪৫৫ রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা পাঠায় মিয়ানমার সরকার। প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্তরা ছিল টেকনাফের ২৩, ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে ২৬ নম্বর শালবাগান ক্যাম্প থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার নাম ছিল তালিকায়। কিন্তু এদিন বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও এনজিওদের চক্রান্তের কারনে কোন রোহিঙ্গাই ফিরে যেতে রাজি হয়নি।
সেসময় সংবাদ ব্রিফিংয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার জানান,প্রত্যাবাসন না হওয়ার ব্যর্থতা বাংলাদেশের নয়। সমস্যাটি মিয়ানমারের। তাই সমাধানের উদ্যোগও তাদের নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার আন্তরিক সহযোগিতা করবে তাদের।তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে গত দুই দিনে ২৩৫টি পরিবারের মতামত নেয়া হয়েছে। আজকেও ১২৬টি পরিবারের মতামত নেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি নয়। তাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। তবে প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত ১০৩৭ পরিবারের মতামত নেওয়া অব্যাহত থাকবে। সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা ইয়া পিং ও জ্যাং থিনজ্যুঁ এবং মিয়ানমার দূতাবাসের এক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
তবে সরকার বারবার চেষ্টা করেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারায় কক্সবাজারের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত বছরের ৪ ডিসেম্বরে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হয়। এ পর্যন্ত ছয় দফায় ১৮ হাজার ৩৩৪ জন শরণার্থীকে স্থানান্তর করেছে সরকার। মোট এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হবে। অনলাইন থেকে সংগৃহীত
0 Comments